বাঙ্গালির সময়ের ঘড়িতে আজো টিকটিক বাজে আমাদের তাজউদ্দিন আহমদের নাম---কানিস রহমান

 




মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার তাঁর এক কলামে একবার লিখেছিলেন এমন করে-

“বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সময়ের পার্থক্য সবসময়ই ছিলো ৩০ মিনিট। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ভারতের মাটিতে থেকে কাজ করত, চলত ভারতের সময়ে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ কোনো দিন তাঁর হাতঘড়ির সময় পরিবর্তন করেননি, সেটি চলত বাংলাদেশের সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি দানবেরা এই দেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলো। তখন আকাশে শকুন উড়ত, নদীর পানিতে ভেসে বেড়াত ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ, শুকনো মাটিতে দাউ দাউ করে জ্বলত আগুনের লেলিহান শিখা, বাতাস ভারী হয়ে থাকত স্বজনহারা মানুষের কান্নায়। শুধু বাংলাদেশের সময়টুকু তারা কেড়ে নিতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদ পরম মমতায় সেই সময়টুকুকে তাঁর হাতঘড়িতে ধরে রেখেছিলেন।

ঘাতকের বুলেট তাজউদ্দীন আহমদের হৎস্পন্দনকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাতের ঘড়িতে ধরে রাখা বাংলাদেশের সময়টিকে কোনো দিন থামাতে পারবে না। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তাজউদ্দীন আহমদের ঘড়ি আমাদের হৃদয়ে টিকটিক করে চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে।"


তাই বলা যায় বাংলাদেশ যতদিন থাকবে বাংলা ভাষাভাষী  মানুষ যতদিন থাকবে  ততদিন বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে একটি মানুষ বেঁচে থাকবে। নামটি হলো বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ নামক রাষ্টটির অভূদ্যয়ে তাজউদ্দীন আহমদ নামক মানুষটাকে আলাদা করার কোন উপায় নেই। বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ৬৬  গণ অভ্যুত্থান ও সর্বোপরি স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে তাজউদ্দীন আহমদ নামটা ইচ্ছে করলেও মুছে ফেলা যাবে না। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। শুধু সহচরই ছিলেন না ছিলেন একজন সত্যিকারের বিশ্বস্ত কর্মী ও নির্মোহ দেশপ্রেমিক। 

তাইতো ভুট্টো বলেছিলঃ

“আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমোশনাল এপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়, কিন্তু তার পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, হি উইল বি আওয়ার মেইন প্রবলেম।”


এমন একজন মানুষের জন্ম হয়েছিল গাজীপুর জেলার (তৎকালীন ঢাকা জেলা) কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই। পাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া মানুষটি নিজের মেধা ও যোগ্যতার বলে চেষ্টা করে গেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে। অত্যন্ত মেধাবী তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্র জীবনে বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ১৯৬৪ সালে আইন শ্রাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন।

পড়ালেখার সাথে সাথে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৩ সালে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। যা তিনি ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৬,১৯৬৮,১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নির্বাচন পরবর্তী প্রতিটি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তাকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে বিভিন্ন সময় অপপ্রচার চালিয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান এবং কোরানে হাফেজ। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রী সভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বিচক্ষণতার জন্য অতি অল্প সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একথা অশনি কার্য। 

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের পরেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন দেশের উন্নয়ন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশকে পুনর্গঠনে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জেলখানার ভিতর। জেলখানায় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ সহ জাতীয় চার নেতাকে। শহীদ হন বাংলার চার বীর জাতীয় নেতা।যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলংকময় অধ্যায়। পরিসমাপ্তি হয় জাতীর একটি আলোকিত অধ্যায়। 


তাই আজ বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ এর জন্মদিনে  তাজউদ্দীন আহমদের বলা সবচেয়ে প্রিয় উক্তিটি দিয়েই আজকের লেখার সমাপ্তি টানতে চাইঃ

“আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করবো। যেন দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এদেশটাকেই খুঁজে পায়; কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে…"


আজকে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ এর জন্মদিনে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা করছি আল্লাহ তাআলা ওনাকে বেহেশত সর্বোচ্চ মাকাম দান করুক।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post