শোকাবহ আগস্ট আমার --- কানিছুর রহমান



আজও বাংলায় হাওর বাওর বিলে সময়ের স্রোতে পানি আসে আবার পানি চলিয়া যায়। ঠিক তেমনি মধুমতি নদীর পারে এক গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। আর দশটি সবুজ শ্যামল ফল ফসলি লতায় পাতায় জরানো একটি গ্রাম। কিন্তু এ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এক বালক। বিখ্যাত শেখ পরিবারে। তাঁর নাম রাখা হয় শেখ মুজিবুর রহমান। যাকে পরিবারের সবাই আদর করে ডাকত খোকা বলে। সে সময়ে অধিকাংশ বাবা মা তার সন্তানকে আদর করে খোকা বলে ডাকত। আর এ খোকা যেমন দুরন্ত তেমনি পরোপকারী। ঠিক তেমনি নিজের কথা সাধারণ মানুষের কথা অকপটে বলে যায়। মানুষের দুঃখ যেমন তাকে ব্যাথিত করে ঠিক দাবি আদায় করিতেও পিছপা হোননা। যেমন স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পরে তা মেরামতের জন্য জরুরি হয়ে পরেছে। সেই কথাটি স্কুলে আগত মন্ত্রী মহোদয়কে বলতে গলা কাপেনি। মেরামতের টাকা আদায় করে ছেড়েছেন। 

ঠিক তেমনি বাংলাদেশ নামক রাষ্টটিকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে নির্বিক চিত্তে এগিয়ে গেছেন। তাইতে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছেন কারা অন্তরালে। জীবনে নিজের সাচ্ছন্দ্যের কথা না ভেবে ভেবেছেন বাংলার আপামর জনসাধারণের কথা। তাইতো কখন আপন মানুষকে সময় দেয়ারও সময় হয়নি তেমন। তাইতো জেল থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর ছেলে তাঁর মেয়ে বলতে হয়ঃ "আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি"। এ থেকে বুঝা যায় বাংলা মাকে তিনি কিভাবে বুকে ধারণ করেছিলেন। তাইতো যখন বাংলাকে শোষণ করে নিঃশেষ করে দিয়েছিল তখন বাংলার আপামর জনতার একটাই আশা বাংলাদেশের স্বাধীনতা।  ঠিক তক্ষুনি একজন ৪৯ বছরের যুবক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বলতে পারে " তোমরা আমার ভাই তেমরা আমার বোন "। সে জনসভায় আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই ছিল। সবাইকে একাকার করে দিয়ে হয়ে গেলেন সকলের আপন সকলের বন্ধু "বঙ্গবন্ধু "। 

সেই মানুষটি শত নির্যাতন নিপিড়ন এর পরও বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি ছাড়া কিছুই ভাবেনি। যে মানুষটি বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রুপান্তর করতে চেয়েছিলেন।  যে মানুষটি এ দেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। সেই মানুষটি কে-ই এদেশের কিছু কুলাঙ্গার নরঘাতক ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ নির্মম ভাবে হত্যা করে। যে নাকি নিজের দেশের প্রতিটি মানুষকে আপন করে নিয়েছিল। তাইতো বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারে " তোরা কে কি চাস"। সেই পাহাড়ের মত মানুষটিকে তারা নিঃসংশ ভাবে হত্যা করল।

দিন যাবে রাত আসবে, আবার রাত আসবে যাবে আসবে নতুন দিন। কিন্তু বাংলার আকাশে নতুন সুর্য উদিত হওয়ার আগ মুহূর্তে নিবেয়ে দেয়া হলো বাংলার নির্মল আকাশের উজ্জ্বল সুর্য রশ্মি কে। হাজারো সকালের মত আজ নতুন সুর্যের সাথে উদিত হলো শোকের মাস আগস্টের। সে রাতে শুধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেনি হত্যা করেছে তাঁর পরিবার ও আত্মীয় স্বজনকেও।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিকষকালো সেই রাতে শহীদ হয়েছিলেনঃ

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।


বঙ্গবন্ধুকে আত্মিকভাবে হত্যা করা হলেও তিনি চিরঞ্জীব। কেননা বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন অমর হয়ে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই তিনি এ জাতির চেতনায় অমর। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।


কিন্তু পরবর্তী সরকার কি করল ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অভিযুক্তদের  মধ্যে ১২ জনকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করল। তার মধ্যে ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল


১. লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব,

২. লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব,

৩. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব,

৪. মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব,

৫. মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব,

৬. মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব,

৭. মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব,

৮. মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব,

৯. কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব,

১০. লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব,

১১. লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব,

১২. লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

শুধু পদায়ন নয় পরবর্তীতে তাদের দায়মুক্তি দিয়ে যে অধ্যাদেশ জারকরা হয়েছিল তা আইনে পরিনত করা হলো।


সত্যি কি বিচিত্র এ দেশ। যেখানে হত্যাকারীকে দায় মুক্তি দেয়া হয়। জাতির কপালে একে দেয়া হয় কলংকের তিলক। বহুদিন সে তিলক আমরা কপালে ধারণ করে চলেছি।পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই বহুল আলোচিত ইনডিমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতিকে দায়মুক্ত করেন। জাতি হয় কলংক মুক্ত। আর জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কিছুটা হলেও দায়মুক্তি মিলেছে। আগস্ট মাসগুলো আমাদের জীবনে একএকটা কলংকময় অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। আগস্টের সেই ঘাতকদের উত্তরসূরীরা জন্ম দিয়েছে ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা। দেশের ৬৩ জেলায় একসাথে সিরিজ বোমা হামলা করে।


রাত পোহালে যে নতুন সুর্য উদয় হয় সে সুর্যের আলোয় নতুন আলো আসুক। আর আমাদের বাংলাদেশের নির্মল সবুজ লতাপাতার দোলায় দুলতে থাকা বাতাসে কোন যুদ্ধাপরাধী ও ঘাতকের নিঃশ্বাসে বিষাক্ত হোক। 


আজ আমাদের প্রত্যয় হোক যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং ঘাতকের বুলেটে আর ক্ষতবিক্ষত না হয় আমার বাংলাদেশ।


লেখকঃ

মোহাম্মদ কানিছুর রহমান 

উপ রেজিস্ট্রার 

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post