নির্বাসিত ভালবাসা(ছোট গল্প)

প্রীতি কর্মকার # 


অনু মধ্যবিত্ত পরিবারের  ছেলে। বাবা  ঔষধালয়ে সামান্য  বেতনে চাকরি করতেন। চাকরির  কারণে  বিভিন্ন দেশে পরিবার সহ স্থানান্তরিত হতে হতো। ছোট বেলা থেকেই অনু পড়াশোনায় ছিল অনেক  মেধাবী। দুরন্তপনার  পরে ও অনেক কম সময়  পড়ে  প্রতিবার পরীক্ষার প্রথম হতো। মা ছিলেন  সাদা মাঠা গৃহিণী। বাবা পড়াশোনা  তদারকি করত খুব। ডানপিটে  দুরন্ত  অনু দেখতে  দেখতে  স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কৃত্বিতের  সাথে  কলেজে ভর্তি হয়। একই বাসায়  ভাড়া থাকতো  শিলা নামের স্কুল  পড়ুয়া  অপুর্ব  সুন্দরী এক কিশোরী।  স্বল্পভাষী শান্ত প্রকৃতির এবং ভালো ছাত্রী  মিশুক  মনোভাব  সকলকে মুগ্ধ  করতো। একসাথে  বড়ো  হওয়ার জন্য  উভয়  পরিবারে  আত্মাীয়তার সম্পর্ক  গড়ে উঠেছে  সুখে  দুঃখে হাসি কান্নায় যেন  তারা  একই বাঁধনে আবদ্ধ।  শিলাদের পরিবার  ছিল সুশিক্ষিত ও প্রভাবশালী। শিলা মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে  প্রায়ই মেধাবী ছাত্র হিসেবে  অনুর সাহায্য  নিতো। এভাবে  দেনা পাওনার হিসেবে  নিজের  অজান্তে ভালো লাগা থেকে  ভালবাসায় রুপ নেয়। এই রুপ নেয়া যে দুপরিবারে এতটা  ফাটল ধরবে কেউ  কল্পনা ও করেনি। ভালবাসা তো আর  হিসাব  কষে  হয়না। ভালবাসা  এমন  এক অনুভূতি কখন যে কেউ  এই মায়াজালে আবিষ্ট হয়ে যায়। ধর্ম, বর্ণ, সমাজ, সংসার  সবকিছুর  উর্ধ্বে থাকে। জীবনের নববসন্ত  উভয়ই স্বপ্ন ও কল্পনার  রাজ্যে অবগাহন করে।এভাবেই  চলছে ভালো থাকায়  দিনগুলো। কিন্তু এ অনুভূতি আড়াল করা কারোপক্ষে সম্ভব নয়, তারাও পারেনি। সবলরা সবসময়  শক্তিশালী হয়। তাই অনুর পরিবারের  উপর এর দায় এবং নির্মম  প্রভাব পরে। অনুর পরিবারকে বলা হয় শুধু  বাসা নয়,জেলা ছেড়ে  চলে  যাওয়ার জন্য। অসহায়  অনুর বাবা কথা দেয়  ছেলের কলেজ  শেষ হলে চিরদিনের  মতো এলাকা ছেড়ে চলে যাবে।কোন দিন  তাঁর  ছেলের সাথে  যোগাযোগ  হবেনা। শুধু কিছু দিন সময় ভিক্ষা চান। পরিবারের অপমান  অনুকে ক্ষত বিক্ষত  করে কিন্তু  বলার কিছু নেই। দুজনেই যেন ডানাকাটা  বিধস্ত  পাখির মতো  ছটফট করছে। চোখে  দেখতে পেলেও  কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারছেনা, নেই কোন যোগাযোগ  মাধ্যম। অন্তর দহনে দগ্ধ হচ্ছে। 

একদিন  অনুর বাসায়  তাঁর  সমবয়সী দাদা বেড়াতে আসলে  দুজনেই  ঘরে বসে  গল্প  করছে হঠাৎ  দেখে  অনু অন্যমনস্ক হয়ে  অপলক দৃষ্টি তে বাইরে  তাকিয়ে  আছে। কারণ  খুঁজে, শিলাকে দেখা  যাচ্ছে। বিপর্যস্ত  মানসিতায়ও অনু প্রথম বিভাগে পাশ করে।এবার  ভালবাসা  নির্বাসনের পালা। অনুর বাবার ইচ্ছে ছিল  ছেলে  ডাক্তার  হবে কিন্তু অনুর মিশন  ভিন্ন। ঢাকা  ভার্সিটিতে ইংরেজিতে  চান্স আসে এবং  নিজের দেশে ফিরে আসে। শিলার পরিবার  কি জানত এই ছেলে  একদিন  উজ্জ্বল  নক্ষত্র  হয়ে জ্বল জ্বল করবে। জানলে  হয়তো সেদিন  ক্ষমতার দাপটে  এতটা  কঠিন  সিদ্ধান্ত  নিতনা। অনু ভার্সিটিতে ভর্তি  হয় কিন্তু পড়াশোনার প্রতি উদাসীনতা, জীবন থেকে  কি যেন হারিয়ে  ফেলেছে। যা হৃদয়ে  থাকে  তা হয়তো ভাগ্যে থাকে না আর যা ভাগ্যে থাকে  হৃদয়ে  স্থান  পায় না।এটাই  নিয়তির  অমোঘ  বিধান।  শুনা যায় মনের  ভার লাঘব করতে  মাঝে মধ্যে  নেশায়  আাসক্ত হয় কিন্ত মধ্য বিত্ত বাবা মায়ের  সে যে একমাত্র অবলম্বন  এ মন্ত্রশক্তি  তাঁকে  বিপথগামী  করতে  পারেনি। চরম  সফলতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সম্পুর্ণ হয়। প্রথম চাকরি  হয় একটি কলেজের ইংরেজি  শিক্ষক হিসেবে। বাবা মায়ের  ও নিজের  স্বপ্নের  সিড়ি  অতিক্রম করতে বিসিএস এ প্রসাশনিক ক্যাডারে নির্বাচিত হয়ে  আর পিছনে  তাকাতে হয়নি। ক্রমান্ময়ে মেধা ও কর্ম দক্ষতায় সর্বোচ্চ  স্থানে নিজেকে স্থাপন করে। এখন  তার  অর্থ , সম্মান সব আছে শুধু নেই অসময়ে হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষ টি। শত প্রাপ্তিতে ও যেন জীবন  অপূর্ণ  হাহাকারের অদৃশ্য  ক্ষত।পরিবারের  সিদ্ধান্ত অনু কে এবার  বিয়ে করতে হবে। মায়ের প্রতি ভালবাসা  তার  মধ্যে  সর্বদা পরিলক্ষিত  হতো। যথাযথ সময়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারে সুদর্শনা, সুশিক্ষিত  মেয়ের  সাথে  বিয়ে  হয়।বিয়ের  পিরিতে বসলে ও হৃদয় ভাঙা  ক্ষতের  দাগ মন থেকে মুছতে  পারেনি। সংসারের দায়বদ্ধতায় চলে  যাপিত জীবন। সময়ের আবর্তনে  জীবনের  অনেক কিছু ই পরিবর্তন হয়। বাবা  বিভিন্ন  রোগে বয়সের ভারে অন্তিমযাত্রা করেন।মাকে ঢাকা  নিজের কাছে রাখতে  অনেক  চেষ্টা করে কিন্তু  স্বামীর  ভিটায় তিনি  প্রশান্তি খোঁজেন। অনু ছুটি  পেলে ই  মায়ের জন্য  বাড়িতে  ছুটে আসে। মা ও ছেলের  আগমন  প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকতো। 

একবার  ছুটিতে বাড়িতে  আসলে হঠাৎ  দেখতে  পায় হাতে  শাখা, সিঁদুর  পরে এক ভদ্রমহিলা এলাকায়  স্কুলের  দিকে  যাচ্ছে। অস্পষ্টতায় ঠাওর  করতে  পারেনি কিন্তু মনে হচ্ছে  খুব  চেনা  কেউ। মনের  মধ্যে কেমন যেন অনুভূতি  তোলপাড়  করছে কে সেই  মহিলা? সারারাত  কাটে  নির্ঘুম, চেনা অচেনার আলোছায়ার প্রতিচ্ছবি।সকালে  কৌতুহল  মিটাতে স্কুলের  রাস্তায়  দাড়িয়ে  থাকে। যথাসময়ে কৌতুহলের অবসান ঘটে। দুজন মুখোমুখি হয়ে  চমকে উঠে  উভয়ই। প্রথমে কেউ  কোন  কথা বলতে পারেনি মনে হয় বাকরুদ্ধ। শিলার কপোল ফ্যাকাশে আভায় বিবর্ণ  হয়ে গেছে। দুজনের  চোখের  দৃষ্টিতে  বেদনার  বহিঃপ্রকাশ। অনু জিজ্ঞেস করল  তুমি এখানে? শিলা বলল আমি  এই স্কুলে  শিক্ষিকা হিসেবে  নতুন  জয়েন করেছি। আমার  স্বামীর চাকরির  সুবাদে এখানে  বদলি হয়। কিন্তু কোন দিন  ভাবতে  পারিনি  আমাদের  এভাবে দেখা  হবে। অনু বলছে ভালো  আছ নিশ্চয়ই। জানবেনা আমি কেমনআছি। শিলা বলল না আমার অনুভূতি  অনুভব করে  তুমি কেমন আছ। আমি জানি  এখনো  ভূলনি আমায়। আমি ও মনের  গহীনে  তোমার  জায়গায়  কাউকে  বসাতে পারিনি শরীর  পাওয়ার সাথে  মনের  কোন সম্পর্ক  নেই। একই ছাদের নিচে  থেকে ও কেউ  কারো  হয়না। শুধু  সামাজিক  দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ। কিছু  ভালবাসায় স্থানীক দুরত্ব  থাকলেও মনের দুরত্ব  থাকেনা। কারো  কারো জীবনে ভালবাসা  অপূর্ণতা,অপ্রাপ্তিতে বিষয়  দ্বীপ রেখা আঁকে নির্বসিত হয় কিন্তু  সেই ভালবাসার  মায়া সজীবতা থেকে  যায়  আমৃত্যু। গভীর  হৃদয়  প্রকোষ্টে অদৃশ্য  রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে  সুখ  বিলাসী  হয়।আমরা না হয়   অপ্রাপ্তিতে নির্বাসিত ভালবাসায় স্মৃতিস্নাত হবো। শুকশারি হয়ে  জীবনের গল্প  নীরবে  নিভৃতেই বয়ে বেড়াব। কেউ কখনো  জানবে না এই গল্পগাথা।

লেখকঃ 

প্রিতী কর্মকার

কালিয়াকৈর,গাজীপুর।

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم