একজন আদর্শবান মহীয়সী নারী ছিলেন বঙ্গমাতা ----- কানিস রহমান




বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন,

‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

…কোনো কালে একা হয়নি ক’জয়ী পুরুষের তরবারী

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’


নারী যেমন পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকে নরকে পথ চলতে সহযোগিতা করছেন ঠিক তেমনি যে কোন বিজয় গাঁথায় হয়েছেন সঙ্গের সঙ্গী। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে আছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা হয়ে উঠার পিছনে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তাইতো এ কণ্টকাকীর্ণ পথ পারি দিতে কোন বাঁধা তৈরি হয়নি। তাইতো মযহারুল ইসলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থে  লিখেছেন, “আমি বঙ্গবন্ধুর অনাবিল সাক্ষাৎকার লাভ করেছি। একবার তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে দুটো বৃহৎ অবলম্বন আছে- একটি আমার আত্মবিশ্বাস, অপরটি- তিনি একটু থেমে আমাকে বললেন, অপরটি বলুন তো কী?’ হঠাৎ এ রকম একটি প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি একটু মৃদু হেসে বললেন, ‘অপরটি আমার স্ত্রী, আমার আকৈশোর গৃহিণী’।" এ থেকেই বুঝা যায় বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা একে অপরের  অবিচ্ছিন্ন সত্তা ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সকল কাজে তিনি সবসময় সহযোগিতা করেছেন। কখনো সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখতে চাননি। তিনি চেয়েছেন বাংলার মানুষের মুক্তি। চেয়েছিলেন স্বাধীন একটি দেশ।  মতের মিল বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে তিনি সর্বক্ষেত্রে হয়েছেন জাতির পিতার ছায়াসঙ্গী। এ প্রসঙ্গে ড. নীলিমা ইব্রাহিম বলেন, ‘রেনু ছিলেন নেতা মুজিবের Friend, Philosopher and Guide।’

বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সময় বঙ্গমাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি মামলা করে। যেখানে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহের মামলা করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ মামলায় বিচলিত না হয়ে আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আইনজীবী নিয়োগ ও মামলা পরিচালনার অর্থ সংস্থানে সচেষ্ট হন। ইতিমধ্যে এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলো। বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবিতে বাঙালি রাস্তায় নামে। সারা বাংলার রাজপথ বিক্ষোভে জনসমুদ্রে পরিণত হয়।


বাংলার উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেও গ্রেপ্তারের হুমকি দেন। আন্দোলনের কারণে কার্যত তখন সরকার পিছু হটে। পাকিস্তান সরকার এ সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্পষ্ট বিরোধিতা করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব



সারা বাংলার আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে তিনি বুঝেছিলেন পাকিস্তান সরকারের শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। তিনি কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর বৈঠকে যেতে নিষেধ করেন। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। ফজিলাতুন নেছা পরামর্শে শেখ মুজিব অনড় থাকেন। প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে শেখ মুজিব  অসম্মতি প্রকাশ করেন। ইতোমধ্যে শেখ মুজিব সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী নিঃশর্তে মুক্তি । মুক্তি লাভের পরদিন ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার শেখ ফজিলাতুন নেছা এই সিদ্ধান্ত যেকোনো মাপকাঠিতে অনন্য হিসেবে স্বীকৃত। ঐ সময়ের একটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। ধারণা করা হয় এ সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করে।


বঙ্গবন্ধু কলকাতায় লেখাপড়া ও রাজনীতি করতেন, দফায় দফায় কারাবরণ করেছেন। এই নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না তার। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘রেনু খুব কষ্ট করত কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।’

বাংলার এ মহীয়সী নারী ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। শৈশবে বাবা-মাকে হারানোর পর শেখ ফজিলাতুন্নেছা বেড়ে ওঠেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে।  

মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন তার চাচি এবং পরবর্তীতে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন। পিতার অভাব বুঝতে দেননি বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর পরিবারে সকলের আদরে স্নেহে বড় হয়ে ওঠেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পিতামাতা নিজের সন্তানদের সাথে শেখ ফজিলাতুন্নেছাকেও ভর্তি করিয়ে দেন স্থানীয় মিশনারি স্কুলে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর এগোয়নি। তবে ঘরে বসেই পড়াশোনা করেছেন তিনি।  


‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘…রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইলো তার দাদা। দাদাও রেণুর সাতবছর বয়সে মারা যান। তারপর, সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। ’  


মাত্র ৩ বছর বয়সে শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ে সম্পর্কে  ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুইবোনকে লিখে দিয়ে যাব। ’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। ’’

বিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধু এন্ট্রান্স পাস করার পরই মূলত তাদের সংসার জীবন শুরু হয়। তাদের বিয়ের ফুলশয্যা হয়েছিল ১৯৪২ সালে।

 তাঁর জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত তিনি ছিলেন একজন বাঙালি  ও আপাদমস্তক বাংলার মুক্তিকামী মানুষের আশ্রয়স্থল। আওয়ামিলীগ এর যে কোন ক্রান্তিলগ্নে তিনি ছিলেন ছায়ার মত। নিজের হাতের বালা ঘরের ফ্রিজ বিক্রি করে সহযোগিতা করেছেন। কুল বধুর মত সংসার আগলিয়েছেন আবার রান্না করে দলের কর্মীদের খায়েছেন। ঠিক স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের নিজের সন্তান বলে আগলে রেখেছেন। বিয়ে দিয়ে তাদের অবিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই মানুষটি আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ১৫ আগস্ট কালরাত্রিতে ঘাতকের বুলেট নিস্তব্ধতা করে দিয়েছে মানবীয় এ মাহা মানবকে। আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের মমতাময়ী মাকে।

আজ বিনম্র চিত্তে তাঁর ৯২ তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আপনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। 

বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন বাঙালির ইতিহাসের সাথে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এর নাম চির অম্লান হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর জীবনগাথা, বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন ও  মুক্তির সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। বাংলার মানুষ হৃদয়ের শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এ মহীয়সী নারী বাংলার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন আপন মহিমায়।


লেখকঃ উপ রেজিস্টার

মাওলানা ভাষাণী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم