শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকার সুবাদে প্রতিনিয়ত সমাজের বিভিন্ন স্তরের ছেলেমেয়েদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় ।
অত্যন্ত কাছ থেকে আমি ওদের দেখতে পারি । ওদের জীবনের বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা জানতে পারি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের নানামুখী সমস্যাগ্রস্ত ছেলেমেয়েদের নিকট থেকে পাওয়া দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এইসব ছেলেমেয়েদেরকে, সেইসাথে সমাজের সকল স্তরের ছেলেমেয়েরা যাতে নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারে, সঠিকভাবে যাতে তাদের বুদ্ধির বিকাশ হয়,তাদের জীবনটা যেন ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়, সেই চিন্ত চেতনাকে কাজে লাগানোর জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
"সকল শিশুকে নিরাপদ রাখি
সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখি।"
বর্তমানে সবাই কর্মব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝে সকলের সুপ্ত চিন্তাগুলো পুনরায় জাগ্রত করার চেষ্টা করছি।
"আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।"
বর্তমান সময়ে মা-বাবা দু'জনেই কর্মজীবী হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সন্তানদের সঠিক যত্ন নেওয়া হয়ে উঠে না।
তবুও তাদের নিরাপদ, সুস্থ ও সুন্দর জীপন-যাপনের জন্য তাদের প্রতি আমাদের আরও বেশী যত্নশীল ও আন্তরিক হতে হবে। সেইসাথে যথাযথ সময় দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যেমন--
একটি গাছের বীজ বপন করার পর তাকে চারিদিকের প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করার জন্য সঠিক যত্ন নিতে হয়,ঠিকতেমনি ভাবেই শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা থেকে নিরাপদ রাখার জন্য আমাদের সবসময় সচেতন থাকা প্রয়োজন।এই সমাজ ও দেশকে সুস্থ ও সুন্দর রাখার প্রধান উপায় হলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠত করা।
বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মা-বাবা কর্মব্যস্ত। এই কর্মব্যস্ততার চাপে, আমাদের আসল সম্পদ আমাদের সন্তানেরা বিভিন্ন দিকে আসক্ত হয়ে পড়ছে । তাদের নৈতিক শিক্ষার চরম অবক্ষয় হচ্ছে। কাদের জন্য আমাদের এই ব্যস্ততা? প্রত্যেকেই তাদের সন্তানকে ভালো রাখার জন্য দিনরাত অর্থ রোজগারের পিছনে ছুটছে। কিন্ত "এই অর্থই একদিন সকল অনর্থের মূল "হয়ে দেখা দেয়। কারন আমরা অর্থের পিছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে সময় দেওয়ার কথা ভুলে যায় । আমরাও অর্থের মাঝেই সকল সুখ খুঁজতে থাকি।
আমাদের সন্তানেরা একা হয়ে পড়ে। তারা নিঃসঙ্গতায় ভোগে। তাছাড়া আমাদের পেশাগত কাজকে ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকের নিকট আমাদের সন্তানদের রেখে যেতে হয়। তখন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। ওদের মনের ভিতরে নানারকম ভয় কাজ করে। তখন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মা-বাবার সাথে আস্তে আস্তে দূরত্ব তৈরি হয়। নিজের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কথা,বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার কথা বলার সময় পায় না।
তখন তারা বাইরে বন্ধু খোঁজে। বাহিরের বন্ধু দেখা যায় কেউ ভালো আবার কেউ খারাপ হয়। এভাবেই আমাদের শিশুরা বিভিন্ন রকম খারাপ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। নানারকম খারাপ মানুষের ফাঁদে পড়ে।
আবার অতিরিক্ত অর্থের লোভে আমরাই নিজেদের সন্তানদের ফাঁদ তৈরি করি। আমরা খাদ্যে বিষ মেশাই। ঔষধে ভেজাল মেশাই। যে নেশাজাতীয় দ্রবের কারনে আমাদের সন্তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হচ্ছে, তার ব্যবস্থা আমরাই করছি । অনেক সম্পদের আকাঙ্ক্ষায়, আমাদের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আমরা সন্তানের খোঁজ নেওয়ার সময় পায় না। কী করে? কোথায় যায়? কেমন বন্ধুদের সাথে মিশে? এর কোন খবর রাখি না। যখন বুঝতে পারি,তখন ফিরিয়ে আনার রাস্তা থাকে না।
বর্তমানে শিশু,কিশোর-কিশোরীরা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। তারা টিকটক,লাইকী, পাবজী,ফ্রি- ফায়ার এই ধরনের বিভিন্ন সর্বনাশা প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। টিকটক, লাইকীর ফাঁদে পড়ে,অনেক শিশু-কিশোরীরা পাচার হচ্ছে। একদিকে আমাদের সন্তানদের জীবন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া এই টিকটক,
লাইকীর ফাঁদে পড়ে কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। যার মাধ্যমে কিশোররা হত্যা,ধর্ষণ,অপহরণ,নারীপাচার, মাদক ব্যবসা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে ।
তাই সকল অভিভাবকদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি,আমাদের সন্তানদেরকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বই আমাদের জীবনকে আলোকিত করে । বই আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু । আসুন, আমরা সকলেই বই পড়ি,অন্যদেরকে বই পড়তে উৎসাহিত করি। বিভিন্ন উৎসবে, বিভিন্ন দিবসে সন্তানদেরকে বই উপহার দেই।
সমাজের প্রতিটি শিশুকে সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে, মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা শুধু তার
মা-বাবার দায়িত্ব নয়,সমাজের সকল স্তরের মানুষের এই দায়বদ্ধতা রয়েছে । তাই আসুন সকল ভেদাভেদ ভুলে,হিংসা বিদ্বেষ ভুলে,লোভকে বর্জন করে, নিজের স্বার্থকে বড় করে না দেখে, প্রত্যেকে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সুবিধা বঞ্চিত শিশু থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের শিশু,কিশোর-কিশোরীদের প্রতি আন্তরিকতার সহিত দায়িত্ব পালন করে সমাজ ও দেশ গঠনের জন্য একজন ভালো মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সকলের সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
(হোমায়রা আক্তার, শিক্ষক ও কবি)