ফিরিয়ে দাও আমার ঈদের আনন্দ

মোহাম্মদ কানিছুর রহমান :



ঈদের আনন্দ আমাকে ছুয়ে যায় না ছোঁয়ার মতো। বিদুতের আলো আমাকে আলোকিত করেছে, কিন্তু আমার আনন্দ গুলোকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে। আমি আলো চেয়েছি জীবন এবং মনকে রাঙ্গানোর জন্য। আমি বিজলি বাতি চেয়েছি অন্ধকার দুর করার জন্য। আমি সব পেয়েছি অনেককিছু হারিয়ে। আজ চারদিকের আলো আর ইট-পাথরের জঙ্গল আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে অনেককিছু।বিশেষ করে রমজানের ঈদের শেষ দুদিন বাবার হাত ধরে ইফতারের পর চাঁদ খোঁজা। কিম্বা আমার সন্তান আমার হাত ধরে অধির আগ্রহে তন্নতন্ন করে পশ্চিম আকাশে চাঁদকে পাওয়া ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কখনো ২৯ রোজা কখনো ৩০ রোজায় চাঁদ খোঁজে পাওয়া।  সে যে কত বড় আনন্দ। আর আজ আমার সন্তানদের দেখি বিশ্বজুড়ে খোঁজ খবর নিয়ে কবে ঈদ হবে তার একটি ধারণা নিয়ে বসে থাকে। আকাশ সংস্কৃতি আমাদের অনেককিছু দিয়েছে, আবার নিয়ে গেছে অনেককিছু। আজও মনের কোনে জায়গা করে নিয়ে বসে আছে অনেক গল্প অনেক কথা। একবার সব বন্ধুরা মিলে একসাথে বসে ভাবলাম আজ চাঁদ উঠলে আমরা মশাল জ্বালাব। যেই ভাবনা সেই কাজ। সারা দিন দাদা আর মেজো চাচার পিছনে পিছনে ঘুরে অনেক কষ্টে একটা মশাল তৈরি করিয়ে নিলাম। কিভাবে আগুন দিতে হবে শিখিয়ে দিল। আমার একচাচা ( বাপের চাচাত ভাই) আমরা একই সাথে একই ক্লাসে পড়ি। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ ধাপে চলে এসেছি। ও করল কি মশাল বানাল পুরনো পলিস্টারের ছেঁড়া শার্ট দিয়ে। আমাদের সবার মশাল ছালার বস্তা কেটে বানানো। চাঁদ দেখার পর সবাই মশাল জ্বালিয়ে দিলাম দৌড় রাস্তা দিয়ে। এমন সময় আমার চাচা ও বন্ধু সে জোরে চিৎকার করে বসে পড়ল। আমারা মশাল নিয়ে তার কাছে গিয়ে দেখি সে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। আমরা মশাল রেখে তার মুখ খুলে দেখি ঠোঁটের উপরের অংশ পুড়ে গেছে। শার্টের পোড়া অংশ লেগে আছে। আব্বা চাচারা ও দাদারা কান্নার শব্দ পেয়ে বাড়ি থেকে ছুটে আসল। তাড়াতাড়ি বাড়ির পাশে একজন গ্রাম্য ডাক্তার ছিল তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তিনি সামান্য চিকিৎসা দিয়ে পাশে কর্পোরেশন এর হসপিটালে নিয়ে ভালো করে চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে আসল। আমার আব্বা, চাচাতো দাদা ও চাচারা কর্পোরেশন এ চাকুরী করতো। যার ফলশ্রুতিতে চিকিৎসা পোতে কষ্ট হলো না। কিন্তু তার সারারাত জ্বর। আমাদের আনন্দ মাটি হয়ে গেল। আমরা সব বন্ধুরা পরের দিন তাকে নিয়ে ঈদের মাঠে গেলাম। সবাই তার পাশে থেকে সমব্যথী হয়ে পার করে দিলাম ঈদ। আমার মনে হয় ওর পাশে থাকা সেই দিনটিই ছিল চমৎকার ঈদ উৎযাপন। আজো কালের সাক্ষী হয়ে তার ঠোঁটের উপর দাগটি রয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি সেই নির্মল ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ বন্ধুগুলোকে। আজও দিন যায় রাত আসে সময়ের আবর্তনে ঈদ আসে। আমাদের সন্তানদের দেখি নেটে ডুকে বুদ হয়ে থাকে। আকাশে বাতাসে শুভেচ্ছা জানায়। এ শুভেচ্ছা কখনো আকাশ বার্তা ঈদের পরে পৌঁছে দেয়। আবার কেউ নেটের বাহিরে থাকলে কবে পায় তার ইয়াত্তা থাকে না।


আজকাল দেখি ঈদের নামাজ শেষে সকলের প্রাণান্ত ছুটে চলার চেষ্টা। কারো সাথে কোলাকুলি করার চেয়ে কোথায় যেন একটা তাড়া লক্ষ করি। কোলাকুলিও মনে হয় হৃদয় ছুয়ে যায় না। আর আমাদের স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে আছে সেই সব দিনরাত্রী। যখন ঈদুল ফিতরে সকালে নাস্তা করে ঈদগাঁ মাঠের প্রাণে পথচলার আগ্রহ। আগে মাঠে যাব সবার সাথে দেখা হবে। তারপর ঈদের নামাজ পরে ছোটবড় সবাই একসাথে একত্রিত হয়ে গ্রামের একপ্রান্ত থেকে সকলের বাড়িতে যাওয়ার পালা। সংখ্যা কখনো বিশ-পচিশ জনের নিচে হতো না। সবাই ঈদগাঁ মাঠে সলাপরামর্শ করে পথচলা শুরু হতো। চেষ্টা থাকতো সকলের বাড়ি যাওয়া। এতে কেউ মাঝখানে চলে যেত আবার কেউ যুক্ত হতো। এতে দেখা যেত প্রতি পাড়ায় লোক সংখ্যা কমতো বাড়ত। কারো বাড়িতে তেমন কিছু খাওয়া হতো না। বেশির ভাগ বাড়িতে পিঠা খাওয়া হতো। কোথাও সবাই মিলে একবাটি মাংশ নিয়ে সবাই মিলেমিশে খেয়ে পথচলা। তাতে করে কোথাও বসে খাওয়া হতো না পেট পুরে। কিন্তু সারাদিন পেট খালি হতো না। পেট ভরে খাওয়া না হলেও মন ভরে যে খাওয়া হতো। সে খাওয়া আর আজকাল হয় না। গ্রামের সকল মা-বোনেরা জানতো আমরা একবার হলেও যাব তাদের বাড়ি। কোন কারণে কারো বাড়ি ফেলে চলতে চাইলে সে যে কতো অভিযোগ শুনতে হতো। তাই সকলেই চাইতো কোন ঘরও যেন বাদ না পরে। আমাদের মনে হতো প্রতিটি পরিবার আমাদের। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি নিজের বাড়ির মতো। সকলকে মনে হতো একই পরিবারের সদস্য। 


সেই ভালোলাগার মুহুর্তগুলোর আমাদের হারিয়ে গেছে। আমার বিজলী বাতির আলোয় আলোকময় হোকনা চারিপাশ। আকাশ সংস্কৃতি আমাদের পরিচিত করুক বিশ্বজগতের সাথে। তাতে আমাদের কোন অনাগ্রহ বা বাঁধা নেই।  কিন্তু আমাদের চিরায়ত বাংলার যে সংস্কৃতি অপরকে আপন করার যে ঐতিহ্য তা যেন হাড়িয়ে না যায়। আমরা যেন মিলেমিশে থাকতে পারি, আমরা যেন আমিত্ববোধে ডুবে না যাই। আমরা যেন সকলে একসাথে একপথে একই উদ্দেশ্যে সুন্দর পৃথিবী বিনির্মানে এগিয়ে চলতে পারি। এই ঈদে এই হোক আমাদের প্রত্যয়।


লেখকঃ উপ-রেজিস্ট্রার

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post