গাঁও গেরামের ঈদ আজও খুঁজে ফিরি

মোহাম্মদ কানিছুর রহমান 


ফুডার ঘরের ফুডা

বারতা বাড়ি গিয়া ফুডা

ভিতরের বাড়ি ফুডাইয়া

গাইডা দিলি ছুডাইয়া।।


চিরায়ত বাংলার ঈদ উৎসবের সাথে এই স্লোগটি বেশ পরিচিত। কারণ আমরা ছোটবেলায় বিভিন্ন রকম বোম ফুটাইতাম। যা আমাদের বাড়ির বড়দের জন্য বেশ যন্ত্রণাদায়ক। কারণ সেই সময় বোমের শব্দ বা গাড়ির শব্দের প্রচলন খুব বেশি ছিল না। কাদা মাটির রাস্তা। গাড়ি বলতে বুঝতাম গরুর গাড়ি কিম্বা মহিষের গাড়ি। আর তার শব্দ মানে ক্যাচরক্যাচ ক্যাচরকেচ। তাই হঠাৎ করে বোমের শব্দ শুনে বাড়ির গৃহপালিত পশু পাখিগুলো নিজেদের অস্তিত্ব জানানোর জন্য একসঙ্গে ডেকে উঠত। আর বাড়ির গরু আর গাভি গুলো অনেক সময় দড়ি ছিড়ে গোয়াল ঘর থেকে বের হয়ে যেতো। এ এক বিরক্তিকর অবস্থা। তাই আমাদের সাবধান করার ছলে কিম্বা ধমকের গলায় বলতো শ্লোকটি।


কিন্তু কে শোনে কার কথা। পাঁচ পয়সা দশ পয়সা দিয়ে বোম বাড়ির পাশের দোকান থেকে কিনে ফুটিয়ে ফাটিয়ে আমরা খড়ের গাদায় পালিয়ে থাকতাম।ফলশ্রুতিতে পরের দিন গা ভর্তি চুলকানির দাগ। আর যদি আমন ধানের খরের গাদা হতো তা হলে সেখান থেকে পাওয়া যেত চেচুড়ি নামক এক ধরনের ছোট ফল। যা খেতে খুবই সুসাধু। একটু চুটকি চুটকি। 


আর একটি কাজ আমাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। আমরা বোমের সাথে আগরবাতি কিনে আনতাম। হয়তো আপনাদের মনে প্রশ্ন উদয় হতে পারে আগর বাতি কেন! হয়তো আপনারা ভাবছেন আগরবাতি দিয়ে ঈদগাঁ  মাঠে সুগন্ধি ছড়ানোর কাজ ! আসলে আমাদের মতো গাঁয়ের দস্যি ছেলেদের এসব মনে আসার সুযোগ কোথায়। আমরা সারাদিন চিন্তা করতাম আজ কে কে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাবে! তাদের আমরা টার্গেট করতাম। জানালা খোলা রেখে ঘুমালে ভালো। না খোলা রাখলে আরো ভালো। চুপিচুপি খেয়াল করতাম কখন ঘুমাতে গেল। আমাদের কাজ শুরু হয়ে যেত। আমরা বারান্দা টার্গেট করতাম। অনেকে বারান্দা বলতে এখন বুঝে লম্বা জায়গা ঘরের চেয়ে ছোট নয়, তার পাশে গ্রীল দিয়ে আটকানো। আমাদের সময় বারান্দা ছিল দেরফুট কিম্বা দুইফুট। যা মটির ঘরের সৌন্দর্য বর্দ্ধন করতো। সেই সাথে বৃষ্টি থেকে ঘরের দেয়ালকে রক্ষা করতো। আমরা করতাম কি বোমের শলতে আগর বাতির মশলার শেষপ্রান্তে বেঁধে দিতাম।তারপর আগরবাতি জ্বালিয়ে চলে আসতাম। আমরা তার আশেপাশেও থাকতাম না। আধাঘন্টা চল্লিশ মিনিট পর আগরবাতি পুড়ে নিচের শেষ প্রান্তে আসার সাথে সাথে গুরুম শব্দকরে পটকা ফেটে যেত। বাড়ির সবার ঘুম তখন দুর পরবাসে। কোথায় বোম বা পটকা খুজতে গিয়ে দেখে পটকাবাজ পগারপার। আমরা তখন গন্তব্য ছেড়ে চলে এসেছি। এ কাজ করতে গিয়ে কতবার যে কারো কারো গোয়ালঘর থেকে গরু বেরিয়ে গেছে আজ আর সংখ্যা গুনে মনে করতে পারি না। হারিয়ে যাওয়া সুখময় স্মৃতিগুলো  নিজের অজান্তে নিজের মাঝে খুঁজে ফিরি আজ। 


ঈদের আগের এইসব দিনরাত্রি পার করে আমরা পরের দিন সকাল বেলা বন্ধুরা সকলে মিলে একসাথে চালের গুড়ের পায়েস খেয়ে দে দৌড় ঈদের মাঠের দিকে। ছোট নদীর পারে বটবৃক্ষের ছায়ার শিরশির হিমেল বাতাসে নিজেদের শরীর মন জুড়িয়ে নেয়া। আর ঈদের দিন নদীর ঘাটে নৌকা থাকলেও মাঝি থাকত না।  মাঝি নেই কিন্তু নৌকা তো ঘাটে বাঁধা থাকত। একপারে বাঁধা নয় দুই পারে দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত। আসলে দড়ি দু'দিকে বেশ কয়েকটি দড়ি  গিট দিয়ে যুক্ত করা থাকতো। এতে সহজেই এপার থেকে ও পারে যাওয়া সহজ হতো। ঈদের মাঠের পাশে মেলার মতো অনেক দোকান বসতো ! বাবার হাত ধরে বায়না কিম্বা ছালামির টাকা দিয়ে সকলে মিলে কিনে ঈদের মাঠে বা নদীর পারে বসে খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আজ আর তা খুঁজে পাই না। আর একটা খাবার আজো খুঁজে ফিরি, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। খাবারটি হলো খাস্তা। রুটির মতো তবে একটু বড় ও নানরুটির মতো পুরো। কিন্তু খুব নরম এবং মিষ্টি। ঈদের দিন সকলে মিলেমিশে একসাথে বসে খেতাম।


আজ এই পরন্ত সময়ে এসে খুব বেশি মনে পরে সেইসব দিনরাত্রির কথা। আরো অনেক গল্পের মধ্যে একটা কথা খুব মনে পরে। আমাদের ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য আমাদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মালম্বী বন্ধুরা নদী পার হয়ে ও বাঁশের সাকো পার হয়ে চলে আসতো। সারাদিন আমাদের সাথে থেকে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতো। আমাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই।  নেই ছুঁৎ অছ্যুৎ এর বালাই। নেই বর্ণবৈষম্যের বালাই। সকলে একসাথে বসে আছি গল্প করছি আড্ডা দিচ্ছি আর খাচ্ছি দাচ্ছি। তাদেরও আপন করে নিচ্ছি এসব দেখে তাদের অনেকের মনের কোনে প্রশ্ন জাগত আমরা কে আর তারা কে। তখন আমরা বলে বসতাম তোমরা আমাদের বন্ধু। তাইতো সবাই বলে "সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই। " সকলে মনের আনন্দে লোকজ  ও বিভিন্ন অসাম্প্রদায়িক গান গাইতাম।

এখানে একটা কথা বলে রাখি আমাদের পারস্পরিক মেলবন্ধনের ফলস্বরূপ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অনেককে দেখেছি ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। তা এই হৃদয়ের গহিনে বসবাস করা আমার আচার আচরণের ফল কিনা জানিনা। 


তবে আমি বিশ্বাস করি ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায়, ঘৃণা দিয়ে নয়। তাইতো আজ এই ঈদের দিনে সকলের প্রত্যয় হওয়া উচিৎ আমরা মানুষকে ভালোবাসব। খোদা যদি সবার মাঝে বিরাজমান তবে সেই মানুষকে ভালোবেসে জীবনকে উৎজীবিতো করাই আমাদের উচিত। পরিশেষে আজ এই দিনে একটা কথা বলেই লেখার সমাপ্ত করতে চাই। 

"রক্ত ঝড়িয়ে নয়

নয় আঘাত করে

সুন্দর একটা হাসি দিয়ে 

মানুষকে ভালোবেসে 

মানুষের হৃদয়ে স্থান করে

নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার 

প্রত্যয় নিয়েই চলে

সকলেই বেঁচে থাকি

মানুষকে ভালোবেসে। "

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post