আমাদের অবরুদ্ধ শহিদ মিনারের মুক্তি চাই-- কানিছুর রহমান


আজ একটা ঘটনার বর্ননা দেব। সালটা খুব সম্ভবত ১৯৮৮ কি ১৯৮৯ হবে। দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসে। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। আমার স্কুলটি ছিল কর্পোরেশন কেন্দ্রিক। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে সকাল বেলা খালি পায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে মেঠো পথে হেঁটে স্কুলে যাওয়া। স্কুলে সকলের সঙ্গে এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে শ্রেণী বা শাখা ভিত্তিক লাইন দিয়ে হেঁটে শহিদ বেদীতে ফুল দেয়া। তারপর জিলেপির গন্ধে দাঁড়িয়ে থেকে  মোনাজাত করে জিলাপি নিয়ে দে দৌড়। কারন কর্পোরেশনের গেটে আবার সকল ছাত্র ছাত্রীদের জন্য প্যাকেট করা জিলাপি কিম্বা আমিত্তি বরাদ্দ। এই ছিল আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি। তারপর হঠাৎ করে আমাদের গ্রামে একদিন বলা হল আমাদের গ্রামের ক্লাবের সামনে শহিদ মিনার হবে। প্রবল আগ্রহ ভরে দেখলাম কিছু যুবক মিলে কলাগাছ সুন্দর করে খবরের কাগজ দিয়ে প্যাঁচিয়ে তিনটি কলাগাছ এমন ভাবে দাঁড় করিয়ে দিলেন মনে হতে লাগল আমার দেখা ইট পাথরের শহিদ মিনারের চেয়ো সুন্দর। তারচেয়ে ভালো লাগা আমার গাঁয়ে আমাদের নিজেদের শহিদ মিনার। বুকের গভীরে একটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করলাম। বিকেলে সবাই মিলে মিটিং বসল। অনেক আলোচনা হল। সকলের একটাই কথা আমরা রাত ১২.০১ মিনিটে শহিদ বেদীতে ফুল দিব।


আমাদের গায়ে তখন ফুল বলতে পলাশ ও শিমুল ফুল বেশি পাওয়া যায়। পলাশ ফুল গাছ থেকে পারতে হতো। আর শিমুল ফুল নিচে পরে থাকতো। তা না হলে বাঁশ দিয়ে পারতে হতো। গ্রামে কয়েক বাড়িতে কিছু গোলাপ ও গাধা ফুলের গাছ ছিল। তারা উনিশ তারিখ থেকে হয় গাছ পাহাড়া দিত। আর টপ থাকলে ঘরে নিয়ে রাখতো। এই ভর সন্ধ্যা বেলায় পলাশ ফুল পাড়া সম্ভব নয়।  আর শিমুল ফুল সংগ্রহ করা আরো কষ্ট সাধ্য বিষয়। বাগান থেকে মোলি বাঁশ কাটা হল। সুন্দর করে ডালা বানানো হল। নিচে কাটুন যোগাড় করে গোল করে কেটে ডালায় লাগানো হল। এখন ফুল যোগার করতে হবে। গাধা ও গোলাপ যাই হোক। গ্রামের যেসব বাড়িতে ফুলের গাছ আছে হানা দিলাম। যা সংগ্রহ হলো তা ডালার সামান্য অংশও হলো না। কারণ না বুঝে ডালা বড় বানিয়ে ফেলেছি। কি করা যায়। আমাদের স্কুলের পাশে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিস। সেখানে অনেক বড় বাগান। কোন বাউন্ডারি নেই। সামান্য তারের বেড়া দেয়া। ইচ্ছে করলেই ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায়। 


যেমন চিন্তা তেমন কাজ। আমরা সবাই স্কুলের ছাত্র। ওতো চিন্তা করার সময় কই। আজ ফুল লাগবেই। চুরি করতে হয় তাই করব। কোন কিছু না ভেবে আমরা কজন বন্ধু এই রাতেই ছুটে গেলাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এর বাগানে। কোথাও কোন জনমানব নেই। শুনশান নীরবতা চারদিক অন্ধকার। নিশ্চিন্তে বাগানে ঢুকে গেলাম। যেই ফুল ছিঁড়তে যাব ঠিক তক্ষুনি পাঁচ ব্যাটারির লাইটের আলোয় বাগান আলোকময়। পাহারাদার যাঁরা ছিল সবাই চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ফেললো। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম। ওনারা আমাদের বললো তোমরা চলে যাও। তোমরা ছোট বাচ্চা তোমাদের কিছু বলব না। আমি সাহস করে বললাম আমাদের ফুল নিতে দিতে হবে। আজ আমরা ফুল নিবোই। যা হয় হবে। আমাদের মারলেও নিব। এই কথা শুনে একজন পাহারাদার হেঁসে দিয়ে বলল, তুমি জান এটা আর্মিদের এলাকা। কি হতে পারে তোমার ধারণা আছে। ফুল যেন চুরি না হয় তার জন্য আমাদের এতগুলো লোক আজ পাহারায় বসিয়েছে। আমরা বললাম তবুও ফুল নিব। এদের মধ্যে একজন বলে উঠলো ফুল দিয়ে কি করবে? তাদের কথায় একটু একটু সাহস হচ্ছিল। এতক্ষণ যেহেতু  কিছু বলেনি বা বকাঝকা দেননি তাই। এবার বুক চিতিয়ে বললাম কাল একুশে ফেব্রুয়ারি। আমাদের গ্রামে প্রথম শহিদ মিনার হয়েছে। আমরা রাতে ডালা বানিয়ে বেদীতে দেব। তার জন্য ফুল চুরি করতে বের হয়েছি। ঠিক তখুনি একজন পাহারাদার অন্যদের ডেকে কি বলল কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর তাঁরা সকলে আমাদের বলল তোমরা দাঁড়াও আমরা আসছি। দুজন থেকে সবাই চলে গেল। 

আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। কিছুটা ভয় কিছুটা আশা নিরাশার দোলাচালে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর যা হলো নিজেও আজ অবধি বিশ্বাস করতে পারিনি। বাগানের মধ্যে ছোট ছোট আলো জ্বলল। মনে হচ্ছিল জোনাকিপোকা যেমন জ্বলে আর নিভে ঠিক তেমন। এভাবে অল্প কিছু সময় ধরে চলার পর পাহারাদার সবাই সামনে চলে আসল। আমাদের হাতে একটা বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল যে পরিমান ফুল দিয়েছি একটা বড়সড় ডালা হয়ে যাবে। এ ফুল নিয়ে সোজা বাড়িতে চলে যাবে। সুন্দর করে ডালা সাজিয়ে বেদীতে দিবে। আর একটা কথা আমার সারা জীবন মনে মধ্যে গেঁথে থাকবে। " আজ তোমরা ফুল চুরি করতে আসনি ফুলকে তার যথাযথ স্থানে পৌঁছে দেয়ার জন্য এসেছ। এভাবেই শ্রদ্ধা জানিও সারাজীবন। তোমাদের প্রতি দোয়া আর ভালোবাসা রইল।" আলো বন্ধ করে আস্তে আস্তে আমাদের রাস্তায় তুলে দিল।

ফুল পেয়ে কিশোর মনে কিযে আনন্দ। সব বন্ধুরা মিলে দে ভোঁদৌড়। বাড়িতে এসে ব্যাগ থেকে ডেলে দেখি অনেক ফুল। গোলাপ গাধা আরো নাম না জানা বিভিন্ন ফুল। 

সবাই মিলে নিজেদের ডালা সাজিয়ে নিলাম রংবেরঙের ফুল দিয়ে। কিছু ফুল বেঁচে গেল। তখন বড়রা আমাদের কাছ থেকে ফুল চেয়ে নিল। তাঁরা বারবার জিজ্ঞেস করল এত ফুল কোথায় পেলাম। আমরা কোন উত্তর দেইনি। সযত্নে গড়া ফুলের ডালি শহিদ বেদীতে দিয়ে মনে হয়েছিল আমরা বীরের বেশে বাড়ি ফিরছি। আজো অন্তরের অন্তস্তল থেকে সেই পাহারাদার সবাইকে অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা জানাই আমাদের মতো তের চৌদ্দ বছরের কিশোরদের হৃদয়ের ভালোবাসার মূল্যায়ন করার জন্য। আপনারা আমাদের হাত দিয়ে যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন আমাদের শহিদদের প্রতি তার জন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকব আপনাদের প্রতি।

আজো আমরা শহিদ বেদীতে ফুল দেই। আজো প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করি। আগের দিন ফুলের দোকানে ডালা বানানোর জন্য টাকা দিয়ে আসি। পরের দিন তা নিয়ে বেদীতে অর্পণ করি। না থাকে আবেগ না থাকে ভালোবাসার স্পর্শ। তাছাড়া এখন জুতা পায়ে থাকে। বেদীতে উঠার সময় পা থেকে বগলে চলে আসে। আবার অনেকে মনের ভুলে  পায়ে দিয়ে বেদীতে উঠে ফুল দিয়ে চলে আসে। আমরা কি আমাদের গাছের ফুল কিম্বা নিজের হাতে তৈরি করা একটি ফুলের তোড়া বেদীতে দিতে পারি না। পারি না! কারন শহিদ মিনার বেয়ে উঠে সবার উপরে আমার ডালাটা বাঁধতে হবে। তারপর ছবি উঠাতে হবে। কিম্বা সবচেয়ে বড় ডালাটা আমার হতে হবে। সবার উপরে থাকতে হবে। কারণ শ্রদ্ধার চাইতে ফেইসবুকে প্রকাশিত ছবি দিয়ে ভাইরাল হতে হবে। 

তখন ভাইরাল হওয়ার লোভ ছিল না। হৃদয়ের গহিনে ভাষা শহিদ দের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। হৃদয়ে তাঁদের জন্য রক্তক্ষরণ ছিল। 

আজ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নেই। তাইতো অবরুদ্ধ শহিদ মিনারে নিশ্চিন্তে ফুল দিয়ে আসছি। আজ আমরা গাজীপুরের মানুষ খাচার ভিতর বন্দী শহিদ মিনার দেখেও না দেখার ভান করে চলে আসছি।

এ প্রসঙ্গে একটা মজার কথা মনে হলো। একবার কথা হচ্ছিল শহিদ মিনার আর রাজবাড়ী মাঠের মাঝখানে রাস্তা কেন। কেনইবা দু'পাশেই দেয়াল। একজন বলে উঠলো তাহলে রাস্তা কোথা দিয়ে হবে। আমি বললাম শহিদ মিনারের পিছন দিয়ে নেয়া যায় না। সে সাথে সাথে বলে উঠল অনেক বড় গর্ত। আমিও সাথে সাথে বলে উঠলাম যে দেশে প্রমত্তা পদ্মার উপর ব্রিজ হতে পারে সে দেশে এ গর্ত টুকু ভরাট করা যাবে না! সে আর আমার কথার কোন উত্তর দিতে পারল না।


একসময় যে শহিদ মিনার ছিল গাজীপুর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র। আজ সে শহিদ মিনার নিথর দাঁড়িয়ে রয়। কখনো কখনো পিঠা উৎসব রাস উৎসব হয়। কিন্তু যখন কোন সাংস্কৃতিক সংগঠন অনুষ্ঠান করতে চায় তখন অনুমোদন আর তালা খোলার ব্যাবস্থা করতে না পেরে বসে যায় রাস্তায়। একবার বঙ্গ রাখাল থিয়েটার আমাকে আমন্ত্রণ জানায় শহিদ মিনারে তাদের নাটক দেখার জন্য। অনেক আগ্রহ নিয়ে যাই নাটক দেখতে। নতুন প্রজন্মের নতুন কিছু দেখব বলে। ওরা আমাকে নতুন অনেক কিছু দেখাল। ওদের নাটকের পটভূমি দেখে আমি অভিভূত। তারচেয়ে অভিভূত তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম দেখে। তাঁরা শহিদ মিনারের বদ্ধ দুয়ারের চাবি পায়নি বলে রাস্তায় চৌকি দিয়ে মঞ্চ বানিয়েছে। মেনে নিলাম। কিন্তু মানুষের চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলাম কেন? বলল চলাচলের রাস্তা বন্ধ করা যাবে না। বাহ বাহ কি সুন্দর আমরা আর আমাদের ব্যাবস্থাপনা। তালাও খুলবে না আবার রাস্তাও বন্ধ করা যাবে না। দেখলাম মঞ্চের পাশ দিয়ে মানুষ যাচ্ছে আর আসছে। অনেক সময় কে পথিক আর কে শিল্পী খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছিল। পরিশেষে যতিন সরকারের একটি কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বারবার বলেন " সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাজ অসংগতি তুলে ধরা আর রাজনৈতিক কর্মীদের কাজ সমস্যার সমাধান করা। এই দুয়ের সমন্বয় ছাড়া রাষ্ট্র বিনির্মান করা কঠিন। "

তাই গাজীপুরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতি আকুল আবেদন আমাদের অবরুদ্ধ শহিদ মিনার কে উন্মুক্ত করে দেয়া হোক তার নকশা অনুযায়ী। আমরা অবরুদ্ধ শহিদ মিনারের মুক্তি চাই।

লেখক:-  মো: কানিছুর রহমান 

সাংগঠনিক সম্পাদক 

রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, গাজীপুর জেলা সংসদ

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post