আমার স্বাধীনতা ---- মোহাম্মদ কানিছুর রহমান


স্কুলের গন্ডি পেরোনোর অপেক্ষায় আছি। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ দেখার জন্য মাঠে যাই। জেলা পর্যায়ের অনুষ্ঠান। সকলেই উপস্থিত। জেলার উর্ধতন কর্মকর্তাসহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা নেতৃবৃন্দ উপস্থিত। কুচকাওয়াজ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে। সবাই দাড়িয়ে পরেছে। মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে নাম। অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য উর্ধতন কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ এগিয়ে যাবে। উপস্থিত সকলের সাথে উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম ঘোষনা করার সাথে সাথে একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর হাতে থাকা জাতীয় পতাকায় লাগানো বাঁশে পতাকা মুড়িয়ে চেয়ারম্যানের দিকে দিল দৌড়ে। আর অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। সাথে বলতে থাকল তোর মতো আলবদর আর রাজাকারকে অভিবাদন দেয়ার জন্য যুদ্ধ করছি। এটা দেখে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। সেই মুক্তিযোদ্ধা তাকে তারা করে মাঠ থেকে বেড় করে দিল। সকলেই তাঁর প্রশংসা করতে লাগলো। আমি তখন কিশোর। তারপর বাড়িতে এসে আব্বাকে বিস্তারিত বললাম এবং আমাকে বুঝিয়ে বলতে বললাম। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানি রাজাকারের কথা অল্প অল্প জানি। তখন বঙ্গবন্ধুর নাম যা আলোচিত হতো আমাদের বাড়িতে। সকলেই আওয়ামি লীগ এর কর্মী বা সমর্থক। তাই আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পকে কিছু জানা। আলবদর শব্দটা একটু নতুন লাগছে। আব্বা আমাকে আলবদর সম্পর্কে বিস্তারিত বলল। যাকে ধাওয়া করেছে সে আলবদর আর তার বাপ এজকন কুখ্যাত রাজাকার। তাই তাকে অভিবাদন না করে তাড়া করেছে। মনে মনে তাঁকে স্যালুট জানালাম। পরবর্তীতে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় হলে তাঁকে সবসময় আমি সম্মান করতাম। মানুষটি একটু ক্ষেপাটে ও আওলাজাওলা। তাঁকে সম্মান করতো খুব কম লোক। আমাকে সম্মান করতে দেখে অনেকে বাঁকা ভাবে দেখতো। কিন্তু আসল ঘটনা বলার পর আর ভুল বুঝত না। তাঁরাও অনেকে সম্মান করতো। আজো সময় সময় তাঁকে দেখি। সালাম বিনিময় হয় আর অন্তর থেকে স্যালুট করি। ভালো থাকবেন আপনি সবসময়। 

এরপর থেকে আমার কাছে স্বাধীনতা মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে নিজের মতো চলা আর নিজের মতো বলা। আমার মধ্যে তৈরি হওয়া অহংকার আমার স্বাধীনতা "কারো দান নয় অর্জন।" সেদিন থেকে স্বাধীনতা আমার। 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানের জান্তা সরকার এদেশটাকে শোষণ করে গেছে। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করার অভিলাষ যখন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে দানা বাঁধে তখন একজন মানুষ চিন্তা করে পাকিস্তান শাসকদের সাথে আর থাকা যাবে না। তিনি সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের একত্রিত করতে উঠে পরে লাগেন। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও চড়াই উৎরাই এর মধ্যে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বারবার জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করে তৈরি করেছেন এদেশের নেতা কর্মীদের। তিনি আর কেউ নন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 


১৯৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভ করার পর পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তালবাহানা করতে থাকে। আর ভিতরে ভিতরে সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাইতো অপারেশন সার্চলাইট এর নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে রাতের আঁধারে সামরিক বাহিনী আক্রমনে নামে। শুরু করে গনহত্যা। এই গনহত্যার জন্য মৌখিক নির্দেশ দেন দুই জন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। এ সম্পর্কে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা -র আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ "এ স্টেঞ্জার ইন মাই ওন কান্টি" তে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হল আরো ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। এরপর সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয় , ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।" পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমন থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের সারারাত নির্মম ভাবে অত্যাচার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে হায়নার দল। বাদ যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক মন্ডলীও। হত্যা করা হয় ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামান সহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" তারপর থেকেই পাকিস্তানি জান্তা সরকার বিভিন্ন স্বরযন্ত্রে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপন করে। আর বাংলাদেশকে শোষণ করার জন্য ক্ষমতা হস্তান্তর না করার স্বরযন্ত্র করতে থাকে।

সেই পথেই  ১৯৭১সালের ২৫ মার্চ রাতে নির্মম হত্যাকান্ড পরিচালনায় লিপ্ত হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নেতৃত্বে। তারা সেই রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। যা ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে রাতেই পাঠ করেন।


আমাদের স্বাধীনতা আমাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। আমাদের সেই ফসলকে ধুলিসাধ করার জন্য   যারা রাজাকার এর গাড়িতে পতাকা দিয়েছিল তারা আজও হায়নার মতো আমার পতাকা খামচে ধরতে চায়। পরাজিত শত্রুরা পশ্চাদপসরণ হলেও তারা তাদের প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে নিরলশ কাজ করে যাচ্ছে। যাতে আমরা একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত হতে না পারি। আমার স্বাধীনতা আমাদের এই পতাকাকে আজও খামচে ধরতে চায় সেই সব শকুনেরা। তাই স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ আর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসের মানুষ যাঁরা তাঁদের এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঐসব হায়নাদের রুখে দিতে হবে। জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে সকলকে এক এক জন স্মার্ট নাগরিক হব আজ ৫৩ তম স্বাধীনতা দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গিকার।


উপ রেজিস্ট্রার 

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,

টাঙ্গাইল।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post